গরুর রোগ ও প্রতিকার
গৃহপালিত পশুর মধ্যে গাভী পালন কৃষিজীবি সমাজের এক দীর্ঘ কালের প্রাচীন ঐতিহ্য। আমাদের দেশে গাভী পালন এক সময় কেবল গ্রামের কৃষিজীবি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু দুগ্ধ চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তা গ্রামীণ কৃষিজীবীদের সীমানা চাড়িয়ে শহরের শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে বহুদিন আগেই। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে এবং তা ক্রমেই সমপ্রসারিত হছে। এটা নিঃসন্দেহে শুভ লক্ষণ। ফরে উন্নত জাতের বাচুর প্রজনন এবং গাভীর যত্নের প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে। গাভী পালনে এর পরিচচর্যা এবং রোগ-ব্যাধি সম্পর্কেও সংশ্লিষ্ট দের সচেতনতা অপরিহার্য। নানা রকমের রোগে আক্রান্ত হতে পারে আপনার বাড়ি কিংবা খামারের পোষা গাভী। এসব রোগ এবং এর প্রতিকার বিষয়েই এবার আলোকপাত করা যাক।
ওলান পাকা রোগ
নানা প্রকার রোগ-জীবাণু বা অন্য কোনো রাসায়নিক দ্রব্যের দ্বারা এ রোগের সৃষ্টি হয়।
লক্ষণ
ক) ওলান লাল হয়ে ওঠে এবং হাত দিয়ে স্পর্শ করলে গরম অনুভব হয়।
খ) ব্যাথার দরুণ গাভী ওলানে হাত দিতে দেয় না এবং দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
গ) হলুদ বর্ণ দুধের সাথে ছানার মতো টুকরা বের হয়।
পুরনো রোগে দুধ কমে যায় এমনকি একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং ওলান শুক্ত হয়ে যায়।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
প্রথমত আক্রান্ত পশুকে পরিস্কার জায়গায় রাখতে হবে। ওলানে জমে থাকা দুধ বের করে দিতে হবে। বাঁচের মুখ বন্ধ হয়ে গেলে টিটিসাইফন দ্বারা বাঁচের মুখ পরিস্কার করে দিতে হবে।
১. ভেলুস ২০%
২. এ্যান্টিবায়েটিক
৩. ম্যাসটাইটিস টিউব ইত্যাদি।
পেট ফাঁপা
সাধারণত গরহজমের জন্য গাভীর পেট ফেঁপে যায়। এছাড়া কিছু কিছু রোগের কারণেও পেট ফাঁপে।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
দানাদার খাদ্য বন্ধ করে দিতে হবে। শুধুমাত্র শুকনা খড় খেতে দেওয়া যেতে পারে।
১. নিওমেট্রিল
২. কারমিনেটিভ মিঙ্চার ইত্যাদি।
জায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা
অনেক রোগের দরুন পাতলা পায়খানা হয়ে থাকে। তবে অস্ত্রর রোগ এদের মধ্যে অন্যতম। আক্রান্ত পশু দূর্বল হয়ে পড়ে।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
১. সকেটিল পাউডার
২. স্টিনামিন ট্যাবলেট ইত্যাদি।
নিউমোনিয়া
ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, রাসায়নিক দ্রবাদি, ঠান্ডা ইত্যাদির কারণে পশুর নিউমোনিয়া হতে পারে।
লক্ষণ
ক) ঘনঘন নিঃশ্বাস এ রোগের প্রধান লক্ষণ।
খ) রোগের শেষ পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট হয়
গ) শুল্ক কাশি হতে পারে।
ঘ) তীব্র রোগে জ্বর হয় এবং নাক দিয়ে সর্দি পড়ে।
ঙ) বুকের মধ্যে গরগর শব্দ হয়।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
১। ভেলুসং ২০%
২। অ্যান্টিবায়টিক
৩। ক্লোরেটেট্রাসন
৪। টেরামাইসিন
৫। ভেটিবেনজামিন
কৃমি
কৃমি নানা জাতের ও নানা আকারের হয়ে থাকে। কৃমিতে আক্রান্ত পশুকে ঠিক মতো খাবার দিলেও তার স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি হয় না। বরং দি দিন রোগা হতে থাকে।
লক্ষণ
ক) পশু দূর্বল হয়ে যায়
খ) খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দেয়
গ) হাড্ডিসার হয়ে যায়
ঘ) সময় সময় পায়খানা পাতলা হয়
ঙ) শরীরের ওজন কমে যায়
ছ) দুগ্ধবর্তী গাভীর দুধ কমে যায়
চ) রক্তশুণ্যতায় ভোগে বলে সহজেই অন্যান্য আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে।
জ) দেহের স্বাভাবিক পুষ্টি ও বৃদ্ধি পায় না।
ঝ) ফলে পশুকে রোগা ও আকারে ছোট দেখায়
চিকিৎসা ও প্রতিকার
গোবর পরীক্ষান্তে কৃমিনাশক ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা করতে হবে।
লক্ষণ
প্রাথমিক অবস্থায়
ক) আক্রান্ত পশু কিছু খেতে চায় না
খ) হাটতে চায় না
গ) জিহবা বের হয়ে থাকে
ঘ) মাথা ও পায়ের মাংসপেশী কাপতে থাকে
পরবর্তী অবস্থায় আক্রান্ত গাভী
ক) বুকে ভর দিয়ে শুয়ে পড়ে
খ) মাথা বাঁকিয়ে এক পাশে কাধের ওপর ফেলে রাখে
গ) এ অবস্থায় গাভী অনেকটা চৈতন্য হারিয়ে ফেলে
ঘ) গাভী কাত হয়ে শুয়ে পড়ে, উঠতে পারে না
ঙ) ধমনীর মাত্রা বেড়ে যায়
চ) অবশেষে গাভী মারা যায়
চিকিৎসা ও প্রতিকার
গাভীকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ক্যালসিয়াম ইনজেকশন দিতে পারলে দ্রুত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।
কিটোসিস
দেহের মধ্যে শর্করা জাতীয় খাদ্যের বিপাকক্রিয়ার কোন প্রকার বিঘ্ন ঘটলে রক্তে এসিটোন বা কিটোন নামক বিষাক্ত দ্রব্য অধিক মাত্রায় জমা হয়ে দেহ বিষিয়ে তোলে। এই বিষক্রিয়ার ফলেই কিটোসিস রোগের সৃষ্টি হয়।
লক্ষণ
ক) ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়
খ) গাভীর দুধ কমে যায়
গ) দৈহিক ওজন কমে যায়
ঘ) কোষ্ঠাকাঠিন্য দেখা দেয়
ঙ) এছাড়া আক্রান্ত পশুর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে এসিটোনের মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায়
চ) অনেক সময় গাভী এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে ঘোরে।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
অপটিকরটেনল-এস ইনজেকশন।
ফুল আটকে যাওয়া
বাচ্চা প্রসবের পর অনেক সময় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফুল বের হয়ে আসে না। এবং এসব ক্ষেত্রে গর্ভ ফুলের অংশ বিশেষ বাইরের দিক হতে ঝুলে থাকতে দেখা যায়।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
১। অকসিটোসিন
২। ইউটোসিল পেশারিস
৩। এ্যানটবায়েটিক ইনজেকশন ইত্যাদি।
জলুবায়ুর প্রদাহ
অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগের জীবাণূ যোনিপথ হতে জরায়ুতে পৌছে এ রোগ হতে পারে। গর্ভ ফুলের টুকরা ভেতরে থেকে গেলে পচে যায় এবং প্রদাহের কারণ ঘটায়। কামপর্বে পশুর যৌন-ক্রিয়ার সয়ও অনেক সময় জরায়ুতে রোগ জীবানূ সংক্রমিত হয়ে থাকে।
লক্ষণ
ক) জ্বর হয়
খ) দুর্গন্ধযুক্ত জলের মতো কিংবা কালচে লাল রঙের স্রাব পড়তে দেখা যায়
গ) খাদ্যে অরুচি হয়
ঘ) দুধ কমে যায়
ঙ) গাভী পাল রাখে না
চিকিৎসা ও প্রতিকার
১। ইউটোলিস পেরারিস
২। এ্যান্টিবায়েটিক ইনজেকশন ইত্যাদি
গর্ভপাত
সাধারণত রোগ-জীবানুর কারণেই অধিকাংশ গর্ভপাত হয়ে থাকে। এছাড়া আঘাত, বিষক্রিয়া, পক্ষাঘাত ইত্যাদি কারণেও গর্ভপাত হতে পারে।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
১। ইউটোসিল পেশারিশ
২। এ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন ইত্যাদি।
অনুর্বরতা ও সাময়িক বন্ধ্যাত্ব
সাধারণত প্রজনন ইন্দ্রিয়সমূহের বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি, হরমোন ক্ষরণের অনিয়ম, অসমতা, ওভারিতে সিস্ট ও পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি কারণে সাময়িক বন্ধ্যাত্ব রোগ হয়ে থাকে।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
সঠিক কারণ নির্ধারণ করে হরমোন দ্বাা চিকিৎসা করলে সাময়িক বন্ধ্যাত্ব দূর হয়। যৌননালীর অসুখের দরুন বন্ধ্যাত্ব হলে ইউটোলিস পেশারিস, স্টিমাভেট ট্যাবলেট জরায়ুতে স্থাপন করতে হবে। ভিটামিন 'এ' যুক্ত সুষম পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।
খুরো বা খুর পচা
খুরের ভিতরের বা চারপাশের টিস্যু পচনশীল অবস্থাকে ফুটরট বলে।
লক্ষণ
ক) আঘাতপ্রাপ্ত টিস্যুতে পচন যুক্ত ঘা হয়
খ) আশপাশের টিস্যুতে রক্ত জমা হতে দেখা যায়
গ) পশু খুড়িয়ে হাঁটে এবং কিছু খেতে চায় না
ঘ) পশুর ওজন ও দুধ কমে যায়
ঙ) শরীরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়
চিকিৎসা ও প্রতিকার
১। ভেসাডিন
২। ভেসুলাং ২০% ইনজেকশন
৩। এ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন
৪। ক্ষতস্থান ভালভাবে পরিস্কার করে দিনে ২ বার ডাস্টিং পাউডার ব্যবহার করতে হবে।
ককসিডিওসিস বা রক্ত আমাশয়
রক্ত মিশানো পাতলা পায়খানা, রক্ত শূণ্যতা ও শরীরের দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্তি এ রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
লক্ষণ
ক) শরীরের তাপমাত্রা অল্প বৃদ্ধি পায়
খ) হঠাৎ করে পায়খানা শুরু হয়
গ) পায়খানার সময় ঘন ঘন কোথ দেয়
ঘ) পায়খানা খুবই দুগর্ন্ধযুক্ত
ঙ) আক্রান্ত পশু দিন দিন দূর্বল হতে থাকে
চ) মলের সাথে মিউকাস অথবা চাকা চাকা রক্ত থাকে
ছ) খেতে চায় না
জ) শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়
চিকিৎসা ও প্রতিকার
১। ভেলুসং ২০% ইনজেকশন
২। সকেটিল পাউডার ইত্যাদি
বেবিসিয়াসিস বা রক্ত প্রস্রাব
আটালি দ্বারা এ রোগের জীবাণূ সংক্রামিত হয়।
লক্ষণ
ক) হঠাৎ জ্বর (১০৮ ডিগ্রী ফা.) হয়
খ) জাবর কাটা বন্ধ করে দেয়
গ) রক্তের সঙ্গে লোহিত কাণিকা ডাঙ্গা হিমোব্লোবিন যুক্ত হবে প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে আসে।
ঘ) প্রস্রাবের রঙ লাল হয়।
প্রতিকার ও চিকিৎসা
১। বেরিনিণ ইনজেকশন
২। শরীরের আটালিমুক্ত করার জন্য নেগুভন সপ্রে অথবা আসানটল সপ্রে দিতে হবে।
উকুন/আটালি
এরা এক প্রকার বহিঃ পরজীবী। অধিকাংশ গবাদি পশু উকুন/ আটালি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
১। নিওসিডল ৪০ ডবি্লউ-পি
২। আসানটল
৩। নেগুভন সপ্রে ইত্যাদি মিশিয়ে পশুর গায়ের সপ্রে করতে হবে।
প্যারাটিউবারকিউলসিস প্রতিরোধ
প্যারাটিউবারকিউলসিস গরুর একটি ছোঁয়াচে রোগ। Mycobacterium paratuberculosis নামের এক জাতীয়ব্যাক্টেরিয়ার কারণে এ রোগ হয়। একে ‘জোনস’ ডিজিসও বলে। এ রোগের ফলে দুগ্ধবতী গাভীর দুধ উৎপাদনমারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এ রোগে গাভী মারাও যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে এক হাজার গাভী রয়েছে এমন একটি দুগ্ধখামার প্যারাটিউবারকিউলসিস রোগের কারণে বছরে প্রায় দুই লাখ ইউএস ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আমাদের দেশেক্ষতির পরিমাণ কত সে বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। প্যারাটিউবারকিউলসিসরোগে দুগ্ধবতী গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। দীর্ঘস্থায়ী এবং ভয়ংকরডায়রিয়া তার মধ্যে অন্যতম। ডায়রিয়ায় পানি ও প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ হারানোর কারণে গরুর শরীর শুকিয়ে যায়,ওজন কমে যায় এবং চামড়া রুক্ষ হয়ে যায়। কয়েক সপ্তাহ পর চোয়ালের নীচে ফুলে উঠে। দেখে মনে হয় বোতল জাতীয়কিছু মুখে রেখে হয়ত মুখ বন্ধ করে আছে। তাই একে ‘বটল জো’ বলে। প্রোটিন ঘাটতির কারণে এমনটি হয়ে থাকে।প্যারাটিউবারকিউলসিস প্রতিরোধ করা মোটেও সহজ নয়। ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণের উৎস কিছুতেই বন্ধ করা যায় না।ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ বন্ধ না করতে পারায় রোগ প্রতিরোধ করাও সম্ভব হয় না। তবে প্যারাটিউবারকিউলসিসপ্রতিরোধে নতুন উপায়ের কথা শুনিয়েছেন আমেরিকান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সার্ভিসের
মাইক্রোবায়োলজিস্ট কিম কুক। কুক ধারণা করেছিলেন পানির পাত্রই হয়ত খামারে ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণের প্রধানউৎস। তাই তিনি পরীক্ষা করে দেখেন পানির পাত্রের ভিন্নতার কারণে ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণে তারতম্য হয় কি না।কংক্রিট, প্লাস্টিক, স্টেইনলেস স্টিল এবং গ্যালভানাইজিং স্টিলের বিভিন্ন ট্রাফে (খামারে গবাদি পশুকে পানি সরবরাহকরার পাত্র) সংক্রমিত পানি নিয়ে তাতে ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা নিরূপণ করেন। তিনদিন পর লক্ষ্য করেন ব্যাক্টেরিয়ারসংখ্যা বহুগুণে বেড়ে গেছে। তিনি তার পর্যবেক্ষণে দেখেন এসব ব্যাক্টেরিয়া ১৪৯ দিন বেঁচে ছিল। কিন্তু স্টেইনলেস স্টিলএবং গ্যালভানাইজিং স্টিলের ট্রাফে ব্যাক্টেরিয়ার বেঁচে থাকার মেয়াদ অনেক কম। এরপর তিনি অপর পরীক্ষায় ট্রাফেরপানিতে প্রতি সপ্তাহে ১০০ গ্যালন পানির জন্য ৩ টেবিল চামচ পরিমাণ হিসেবে ক্লোরিন যোগ করেন। এবার আরোবিস্ময়কর ফলাফল লক্ষ্য করেন। তিন সপ্তাহ পর দেখেন কংক্রিটের ট্র্যাফেতে ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪শতাংশে, প্লাস্টিকের ট্র্যাফেতে ২০ শতাংশে। কিন্তু স্টেইনলেস স্টিল এবং গ্যালভানাইজিং স্টিলে ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণঅবশিষ্ট ছিল ১ শতাংশেরও কম। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, কনক্রিটের উচ্চমাত্রার পিএইচ ক্লোরিনেরকর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে কনক্রিটের ট্রাফেতে ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ বেশি ছিল। প্লাস্টিকের ট্রাফেতে ব্যাক্টেরিয়ারসংখ্যা বেশি থাকার কারণ প্লাস্টিক ক্লোরিন শুষে নেয়। ফলে ক্লোরিনের কর্মক্ষমতা অক্ষুন্ন থাকে না। কিন্তু স্টেইনলেসস্টিল এবং গ্যালভানাইজিং স্টিলের ট্রাফেতে ক্লোরিনের কর্মক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকায় ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা প্রায় নিমূলহয়ে গিয়েছিল। কুক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, স্টেইনলেস স্টিলের ট্রাফেতে পানি সরবরাহ করা হলে খামারেপ্যারাটিউবারকিউলসিসের মাত্রা কমাতে সহায়তা করবে। সাথে ক্লোরিন যোগ করা হলে এর মাত্রা বহুলাংশে হ্রাস পাবে।তাই খামারে প্যারাটিউবারকিউলিসিস রোগ প্রতিরোধে স্টেইনলেস স্টিলের পাত্রে ক্লোরিন মিশ্রিত খাবার পানি সরবরাহকরার পরামর্শ দিয়েছেন কুক।
লেখক: ডা.হাসান মুহাম্মদ মিনহাজে আউয়াল, ডিভিএম, পিজিটি, জামালপুর
গরুর প্রাণঘাতী রোগ ব্যাবেসিওসিস
জমিলা খাতুন চার বছর হলো দু’টি গাভী পালন করছেন। গাভীর দুধ বিক্রিই তার আয়ের একমাত্র উৎস। ক’দিন ধরেলক্ষ্য করছেন, একটি গাভী ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে না। কানের গোড়ায় হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর জ্বরও লাগছে।একদিন দুপুরে দেখলেন গাভীটির প্রস্রাব রক্তের মতো লাল। পায়খানাও লালচে ধরনের। ভীষণ ভয় পেলেন তিনি। কারণএ ধরনের অসুখ আগে কখনো কোনো গরুর হয়নি। স্খানীয় পশু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন তিনি। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যবস্খাপত্র দিলেন। পরদিন থেকেই গাভীটির প্রস্রাব স্বাভাবিক হয়ে এলো এবং কয়েক দিনের মধ্যে পুরোপুরিসুস্খ হয়ে উঠল।
যেকোনো গরুরই এ ধরনের রোগ হতে পারে, যার নাম ব্যাবেসিওসিস। পরজীবীঘটিত একধরনের রোগ। Boophilus microplus নামের এক ধরনের উকুনের কামড়ে এই পরজীবী গরুর দেহে প্রবেশ করে রক্তের লোহিত কণিকায় আশ্রয়নেয়, সেখানেই বংশ বৃদ্ধি করে। ক্রমেই অন্যান্য লোহিত কণিকায়ও আক্রমণ করে। এতে লোহিত কণিকা ভেঙেহিমোগ্লোবিন রক্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে আসে। বেশি লোহিত কণিকা আক্রান্ত হলে গরুররক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
রোগের লক্ষণ : জ্বর হচ্ছে এই রোগের প্রথম লক্ষণ। জীবাণু বহনকারী উকুনের কামড়ের প্রায় তিন সপ্তাহের মধ্যেই জ্বরদেখা দেয়। গরু ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। শ্বাস গ্রহণের চেয়ে শ্বাস একটু জোরে ত্যাগ করে। খাবারের রুচি কমে যায়।আক্রান্ত গরু দুর্বল হয়ে যায়। চোখ এবং দাঁতের মাড়ি ফ্যাকাশে হয়ে যায়। প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হয়। অনেক সময়পায়খানার সাথেও রক্ত বের হতে পারে। গর্ভবতী গাভীর ক্ষেত্রে গর্ভপাত হতে পারে। গরু কোনো কিছুর সাথে মাথা ঘষা, বৃত্তাকারে চার দিকে ঘোরাসহ এই ধরনের নানান অসংলগ্ন আচরণ করতে পারে। পক্ষাঘাত, অচেতন হয়ে যাওয়া এবংশেষ পর্যন্ত মৃত্যুও হতে পারে।
পোস্টমর্টেম লক্ষণসমূহ : মৃত গরুর দেহ পোস্টমর্টেম করলে হৃৎপিণ্ড ও অন্ত্রে সাব সেরোসাল হেমোরহেজ দেখা যায়। প্লীহাকিছুটা বড় হয়ে যায়। দেখতে লালচে ও নরম হয়। যকৃৎ আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হতে পারে।
রোগ সনাক্তকরা : রোগের লক্ষণ দেখে এ রোগ নিরুপণ করা যায়। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আক্রান্ত গরুর রক্ত পরীক্ষাকরা হয়।
চিকিৎসা : রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা দিলে দ্রুত সেরে যায়। এই রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধরয়েছে। বাজারে এখন যেসব ওষুধ পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে ইমিডোকার্ব ও ডিমিনাজেন এসিচুরেট বেশি ব্যবহারকরা হয়। ট্রিপেন ব্লুও প্রয়োগ করা হয়। মনে রাখা প্রয়োজন, কিছু ওষুধ রয়েছে বিষাক্ত। তাই সব সময় ডাক্তারেরপরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা উচিত।
প্রতিকারমূলক ব্যবস্খা : প্রতিরোধমূলক ব্যবস্খার মধ্যে উকুন নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এ জন্য যেসব এলাকায় এই উকুনেরপ্রাদুর্ভাব বেশি সেখানে পানির মধ্যে একারাসিড জাতীয় ওষুধ গুলে গরুকে গোসল করাতে হবে। তাতে গরুর শরীরউকুনমুক্ত হবে। চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর পর গোসল করালে উকুনের আক্রমণের সম্ভাবনা কমে। দেশীয় গরুগুলোররোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বলে এই রোগে কম আক্রান্ত হয়। কিন্তু সঙ্কর জাতের কিংবা বিদেশী জাতের গরু সহজেই এইরোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ জন্য ভ্যাকসিন দেয়া প্রয়োজন। অবশ্য কোনো গরু একবার এই রোগে আক্রান্ত হলে পরেআক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে। কারণ আক্রান্ত হওয়ার ফলে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নেয়। গরুকে রোগবালাইথেকে রক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্খা সবচেয়ে বেশি কার্যকর। এ ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সুষ্ঠু ও যত্নশীলপরিচর্যা গরুকে এ রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। কোনো কারণে রোগগ্রস্ত হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসার ব্যবস্খা করাএ রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাস করবে।
পোলট্রি: হিটস্ট্রোক এড়ানোর উপায়
প্রচণ্ড গরম পড়েছে সারা দেশে। প্রায় সব খামারেই হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছে মোরগ-মুরগি। গরমের সময় মোরগ-মুরগিচারপাশের তাপের কারণে তার দেহ থেকে তাপ বের করতে পারে না বলে শ্বাসকষ্ট হয় এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।একসময় এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় বলে মোরগ-মুরগি হিটস্ট্রোকে মারা যায়।
লক্ষ রাখতে হবে ফিড : এ সময় মুরগির ফিড গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়। সেই কারণে দিনের নির্দিষ্ট বেশি গরমের সময়ব্রিডার লেয়ারের ক্ষেত্রে ফিড না দেওয়াই ভালো। শুধু পানি খাবে। দিনের ঠাণ্ডা সময় যেমন ভোর ও সন্ধ্যার পর ফিডদিতে হবে।
এ সময় খামারে দেওয়া ফিডে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে, ফিডে যেন পুষ্টিমান সঠিক এবং বেশি থাকে। যেমন স্বাভাবিক১০০ গ্রাম ফিডের পুষ্টি ৯০ গ্রাম ফিডে থাকতে হবে। সে কারণে ফিডে ব্যবহার করা প্রোটিনের ক্ষেত্রে অতি উচ্চমানেরপ্রোটিন ব্যবহার করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে, এই প্রোটিনে প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড মিথুনিন, লাইসিন ঘাটতিআছে কি না? যদি ঘাটতি থাকে তাহলে বাড়তি অ্যামাইনো এসিড মেশাতে হবে।
খামারে রেডি ফিড (পিলেট ফিড) ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফিডে অ্যামাইনো এসিড মেশানোর উপায় থাকে না। সে ক্ষেত্রেপানির মাধ্যমে তরল মিথুনিন যেমন রেডিমেড এটি-৮৮ পানিতে খাওয়াতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে এক থেকে দুইমিলিলিটার দিতে হবে। এ ছাড়া অন্যান্য অ্যামাইনো এসিডের ঘাটতি পূরণের জন্য অ্যামাইনো লাইটস এবং অ্যামাইনোএসিড ও শক্তি সরবরাহের জন্য অ্যামাইনো-১৮ পানির সঙ্গে খাওয়াতে হবে।
হিটস্ট্রোক প্রতিরোধ : গরমের সময় রক্ত চলাচল দ্রুততর হওয়ার জন্য হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় ও কোনো কোনো সময়রক্ত জমাট হতে পারে। এই রক্ত জমাট হওয়াটাই হিটস্ট্রোক। এতে মুরগি মারা যেতে পারে। এ সময় এসপিরিন ওভিটামিন-সিযুক্ত কোনো মিশ্রণ যেমন এন্টি স্ট্রেস প্রিমিক্স দিনের উষ্ণতম সময় যেমন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টাপর্যন্ত পানির মাধ্যমে খাওয়ালে হিটস্ট্রোকের পরিমাণ অনেক কমে যায়। এ ছাড়া ফিডেও ভিটামিন-সিযুক্ত প্রিমিক্সব্যবহার করা যেতে পারে।
গরমের বাড়তি যত্ন : গরমে পোলট্রি খামারে বিশেষ যত্ন না নিলে ফ্লকে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এখনকারতাপজনিত ধকলে মুরগির দৈহিক ওজন কমে যাওয়াসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ডিম উৎপাদন কমে যায় এবংমোরগ-মুরগির মৃত্যুও হতে পারে। এ সময় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।
খামারে এক দিনের বাচ্চা আসার আগে পরিষ্কার ও ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে পানির সঙ্গে ভিটামিন সি,আখের গুড় অথবা ইলেকট্রোলাইটযুক্ত স্যালাইন পানির সঙ্গে দিতে হবে।
খামার শেডে বাতাসের অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। মুক্ত বাতাস শেড অভ্যন্তরের তাপমাত্রা শীতল রাখবে, সেই সঙ্গে অ্যামোনিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের বিষক্রিয়াও মুক্ত রাখবে। শেডে সিলিং ফ্যানের পাশাপাশি এগজস্টফ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে।
শেডে মোরগ-মুরগি যেন আরামদায়ক পরিবেশে বাস করতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। অহেতুক এদের বিরক্ত করাযাবে না। প্রতিটি বড় মুরগিকে এক বর্গফুটের অধিক জায়গা দিতে হবে।
অধিক রোদে টিনের চালা অতিরিক্ত গরম হলে দিনে দুই-একবার চালায় পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। টিনেরচালার নিচে চাটাই, হার্ডবোর্ড দিয়ে শিলিংয়ের (চাতাল) ব্যবস্থা করতে হবে।
শেডের চারপাশে সপ্তাহে দুবার চুন ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ব্রয়লার লিটার ভোর কিংবা রাতে ওলটপালট করেদিতে হবে।
খাবার পাত্র ও পানির পাত্রসংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হবে। পানির পাত্রে দিনে কমপক্ষে তিনবার পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানিসরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। গরমের ধকলের কারণে মাইকোপ্লাজমা ও কলিব্যাসিলোসিস রোগের আক্রমণ বেড়েযায়। সে কারণে এ সময় মুরগির স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলা প্রয়োজন। বিশেষ করে ফিড ও পানিতে ভিটামিন-সি ওভিটামিন-ই ব্যবহার করতে হবে।
গরমকালে বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায় শেডের মেঝেয় অনেক সময় লিটার দ্রুত ভিজে যায়। যার ফলে রোগআক্রমণও বেশি হয়। সে কারণে লিটারে পাউডার চুন ব্যবহার করতে হবে। এ সময় ফিডের বস্তা খোলা রাখা যাবে না।কারণ বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে ফিডে ছত্রাক বা মোল্ড জন্মায়, যা পোলট্রি খাদ্যের উপযুক্ত নয়।
গবাদি পশুর গলাফুলা রোগ ও প্রতিকার
গলাফুলা একটি তীব্র প্রকৃতির রোগ যা গরু এবং মহিষকে আক্রান্ত করে। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ যাPasteurella multocida দ্বারা সংঘটিত হয়। এ রোগে মৃত্যুর হার খুবই বেশি। বর্ষাকালে গলাফুলা রোগ বেশি দেখাযায়। আমাদের দেশে বর্ষার শুরুতে এবং বর্ষার শেষে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। পশুর শরীরে স্বাভাবিক অবস্থায় এরোগের জীবাণু বিদ্যমান থাকে। কোনো কারণে যদি পশু ধকল যেমন ঠান্ডা, অধিক গরম, ভ্রমণজনিত দুর্বলতা ইত্যাদিরসম্মুখীন হয় তখনই এ রোগ বেশি দেখা দেয়। গলাফুলা রোগের প্রচলিত নাম ব্যাংগা, ঘটু, গলগটু, গলবেরা ইত্যাদি।
চিত্র-১ গলাফুলা রোগে আক্রান্ত পশুর মুখমন্ডলসহ গলা ফুলে উঠেছে
এপিডেমিওলজি ও রোগজননতত্ত্ব
গলাফুলা (hemorrhagic septicemia) এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপের কিছু দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যমান। তবেদক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটি বেশি পরিলক্ষিত হয়। গলাফুলা মূলত গরু ও মহিষের রোগ হলেও শুকর, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, বাইসন, উট, হাতী এমনকি বানরেও এ রোগ হতে পারে। এ রোগ বছরের যে কোনো সময় হতে পারে তবে বর্ষাকালে এরপ্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। বাহক পশুর টনসিল ও ন্যাজো-ফ্যারিনজিয়াল মিউকোসায় এ রোগের জীবাণু থাকে। অনুকূলপরিবেশে রক্তে এ রোগের জীবাণুর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে septicemia করে। এই বৃদ্বিপ্রাপ্ত জীবাণু মরে গিয়ে এন্ডোটক্সিননিঃসৃত হয় যার ফলে রক্ত দূষিত হয়ে পড়ে। এন্ডোটক্সিন রক্তের ক্যাপিলারিস নষ্ট করে; ফলে এডিমা হয়। এছাড়াএন্ডোটক্সিন একদিকে কোষ কলা বিনষ্ট করে দেহে হিস্টামিনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে অন্যদিকে টিস্যু বিনষ্টের ফলে টিস্যুরপ্রোটিন ভেঙ্গে রক্তে প্রোটিনের পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে, এডিমার সৃষ্টি হয়। সে কারণে এ রোগে আক্রান্ত পশুর গলা ফুলেযায় ও রক্তে জীবাণুর উপস্থিতির (septicemia) কারণে পশুর দ্রুত মৃতু্য হয়।
লক্ষণ
এ রোগ অতি তীব্র ও তীব্র এ দুই ভাবে হতে পারে। অতি তীব্র প্রকৃতির রোগে হঠাৎ জ্বর (১০৬-১০৭০ ফা) হয়ে মুখ ওনাক দিয়ে তরল পদার্থ বের হতে থাকে। পশু অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে ও খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে মৃতু্যঘটে। তীব্র প্রকৃতির রোগে আক্রান্ত পশু ২৪ ঘন্টার অধিক বেঁচে থাকে। এ সময় পশুর এডিমা দেখা দেয় যা প্রথমে গলারনিচে, পরে চোয়াল, তলপেট এবং নাক, মুখ, মাথা ও কানের অংশে বিসতৃত হয়।
গলায় স্ফীতি থাকলে গলার ভেতর ঘড় ঘড় শব্দ হয় যা অনেক সময় দূর থেকে শোনা যায়। প্রদাহযুক্ত ফোলা স্থানে ব্যথাথাকে এবং হাত দিলে গরম ও শক্ত অনুভূত হয়। সূঁচ দিয়ে ছিদ্র করলে উক্ত স্থান হতে হলুদ বর্ণের তরল পদার্থ বের হয়েআসে। অনেক সময় কাশি হয় এবং চোখে পিচুটি দেখা যায়। নাক দিয়ে ঘন সাদা শ্লেষ্মা পড়তে দেখা যায়। সাধারণতলক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আক্রান্ত পশু মারা যায়। মারা যাবার সাথে সাথে পেট খুব ফুলেউঠে এবং নাক ও মুখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হতে থাকে। পোস্টমর্টেম করলে পেরিকার্ডিয়াল স্যাক (pericardial sac) এ রক্ত মিশ্রিত তরল পদার্থ দেখা যায়, যা থোরাসিক (thoracic) এবং এবডোমিনাল ক্যাভিটি (abdominal cavity) তে বিসতৃত হতে পারে। ফ্যারিনজিয়াল এবং সার্ভাইক্যাল লিম্ফনোডে বিন্দু আকৃতির (petechial) রক্তক্ষরণ পরিলক্ষিতহয়।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
গলাফুলা রোগের যথেষ্ট অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে বিশেষত, এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু দেশে। এশিয়াতে ৩০% গবাদিপশু এ রোগের প্রতি সংবেদনশীল। ভারত দুগ্ধ উৎপাদনে এশিয়াতে সর্বোচ্চ যেখানে ৫০% দুধ আসে মহিষ থেকে,যারা এ রোগের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। ভারতে গত চার দশক ধরে গলাফুলা রোগে মৃত্যু হার গবাদিপশুর মৃত্যুহারের৪৬-৫৫%। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ভারতে গবাদিপশুর ৫টি মহামারীতে আক্রান্ত গবাদিপশুর ৫৮.৭% মারাযায়। এই ৫টি মহামারী হল ক্ষুরারোগ, রিন্ডারপেষ্ট, বাদলা, এনথ্রাক্স এবং গলাফুলা। শ্রীলংকায় ১৯৭০ এর দশকেপরিচালিত একটি অপঃরাব সারভ্যাইল্যান্স স্টাডিতে দেখা গেছে গলাফুলা আক্রান্ত স্থানসমূহে বছরে প্রায় ১৫% মহিষএবং ৮% গরু গলাফুলার কারণে মারা যায়। পাকিস্তানে একটি রির্পোটে দেখা গেছে সেখানে গবাদিপশুর মোট মৃত্যুর৩৪.৪% মারা যায় গলাফুলা রোগে। মায়ানমারে পশু রোগ নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দকৃত মোট বাজেটের ৫০ ভাগ ব্যয় হয়গলাফুলা রোগ দমনে। গলাফুলা রোগে শুধু গবাদিপশুর মৃত্যুই ঘটে না, সাথে সাথে বেশ কিছু অপ্রত্যক্ষ ক্ষতিও হয়।যেমন -
উৎপাদন হ্রাসঃ মাংস, দুধ, জোয়াল টানা, হালচাষের বিকল্প উপায়ের জন্য মোট ব্যয় ইত্যাদি। পশুর প্রজনন ক্ষমতাবিঘি্নত হওয়া, চিকিংসা খরচ ইত্যাদি।
প্রতিরোধ
এ রোগ উচ্ছেদ করা অসম্ভব কারণ এ রোগের জীবাণু স্বাভাবিক অবস্থায় পশুর দেহে থাকে। তবে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাঅবলম্বন করে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
রোগাক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা করে সুস্থ পশুকে টিকা দানের ব্যবস্থা করতে হবে।
মড়কের সময় পশুর চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পশুর পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে।
টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত এল.আর. আই কতৃর্ক প্রস্তুতকৃতটিকার নাম গলাফুলা টিকা। লোকাল স্ট্রেইন দ্বারা প্রস্তুতকৃত এই অয়েল এডজুভেন্ট টিকা সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক (৬ মাসবয়সের উপরে) গবাদিপশুকে ২ মিলি মাত্রায় ও ছাগল ভেড়াকে ১ মিলি মাত্রায় প্রয়োগ করতে হয়। এ রোগের প্রাদুর্ভাবআছে এরূপ এলাকায় ৬ মাস বা তদুধর্ব বয়সী বাছুরে প্রাপ্ত বয়স্ক গরুর অর্ধেক মাত্রায় টিকা দিতে হয়। এলামঅধঃপাতিত (Alum precipitated) টিকা মাংসে প্রদান করা হয়। যেহেতু দুই ধরনের টিকাই মাঠপর্যায়ে ব্যবহার হয়তাই বিষয়টির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ অয়েল এডজুভেন্ট টিকা তেল থেকে প্রস্তুতকৃত বিধায় এই টিকাভুলক্রমে মাংসে প্রদান করলে মাংসে প্রদাহ সৃষ্টি হয়ে মাংসের ক্ষতি হয় এবং সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। টিকা প্রদানের২-৩ সপ্তাহ পর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মাতে শুরু করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ১ বৎসর কাল পর্যন্ত বজায় থাকে। এইটিকা মৃত জীবাণুর দ্বারা প্রস্তুত বিধায় এই টিকা প্রদানের মাধ্যমে রোগ বিস্তারের কোনো সম্ভাবনা নাই। টিকা প্রয়োগেরস্থান ২/৩ দিন পর্যন্ত ফোলা থাকতে পারে। ত্রুটিপূর্ণ ইনজেকশনের কারণে এই ফোলা স্বাভাবিক এর চেয়ে কয়েকদিন বেশিথাকতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে এনাফাইলেকটিক শক দেখা দিতে পারে। কোনো এলাকায় বা খামারে টিকা প্রদানের পূর্বে অল্পকয়েকটি গবাদিপশুকে টিকা প্রদানের পর ২৫-৩০ মিনিট অপেক্ষা করে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় কিনা তাপর্যবেক্ষণ করা শ্রেয়। যদি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তবে উক্ত বোতলের টিকা পুনরায় ব্যবহার করা যাবে না। অয়েলএডজুভেন্ট টিকা বেশ ঘন হওয়ায় এই টিকা প্রদানে মোটা বারের নিডল ব্যবহার করা সুবিধাজনক।
রোগ নির্ণয়
হঠাৎ মৃত্যু হয় এ ধরনের রোগ যেমন বজ্রপাত, সাপে কাটা, বাদলা রোগ, রিন্ডারপেস্ট, এনথ্রাক্স ইত্যাদি থেকেগলাফোলা রোগকে আলাদা করতে হবে। সেরোলজিক্যাল টেস্ট যেমন Indirect hemagglutination test এ উচ্চটাইটার লেভেল (১:১৬০ বা তার বেশি) পাওয়া গেলে এ রোগ সমন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়।
চিকিৎসা
আক্রান্ত পশুর চিকিৎসায় বিলম্ব হলে সুফল পাওয়া যাবে না। তাই রোগের উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে চিকিৎসারব্যবস্থা করতে হবে। এ রোগের চিকিৎসায় সালফোনামাইড গ্রুপ যেমন সালফাডিমিডিন (৫০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য১৫-৩০ মিলি হিসেবে প্রত্যহ একবার করে তিনদিন শিরা বা ত্বকের নিচে), ট্রাইমিথোপ্রিম-সালফামেথাক্সাসোল কম্বিনেশন(৪৫ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৩-৫ মিলি), অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, পেনিসিলিন ও ক্লোরামফেনিকল জাতীয় ঔষধ অধিককার্যকর।
Ampicillin, Tetracycline, Erythromycin, Sulphonamide জাতীয় ইনজেকশন গভীর মাংসে দিয়ে ভাল ফলপাওয়া যায়। Sulphadimidin ঔষধ শীরায় প্রয়োগ করে দ্রুত ফল পাওয়া যায়। আমাদের দেশে এ চিকিত্সাটা বেশিব্যবহূত হয়। Oxytetracycline/Streptophen ইনজেকশন গভীর মাংসে প্রয়োগ করে কার্যকরী ফল পাওয়া যায়।টিকার ব্যবহার মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি: বাংলাদেশের মহাখালীর খজও -এ টিকা পাওয়া যায়- ১. অয়েল এ্যাডজুভেন্টটিকা: গরু/মহিষ- ২ মি.লি চামড়ার নিচে দিতে হয়। ছাগল/ভেড়া- ১ মি.লি চামড়ার নিচে দিতে হয়। (অয়েলএ্যাডজুভেন্ট টিকা ঘন হওয়ায় মোটা বোরের নিডল ব্যবহার করতে হবে)।
প্রতিরোধ
ভ্যাকসিনই এ রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে ভাল উপায়। মূলত তিন ধরনের ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এগুলোহল প্লেইন ব্যাকটেরিন, এলাম অধ:পাতিত ব্যাকটেরিন এবং অয়েল এডজুভেন্ট ব্যাকটেরিন। এর মধ্যে ৬ মাস বিরতিতেএলাম অধ:পাতিত ব্যাকটেরিন এবং ৯ থেকে ১২ মাস অন্তর অয়েল এডজুভেন্ট ভ্যাকসিন দিতে হয়। ভালো ব্যবস্থাপনায়পরিচালিত খামারে বাছুরকে ৩ থেকে ৬ মাস বয়সে প্রথম, ৩ মাস পরে বুস্টার এবং এরপর বছরে একবার টিকা দিতেহয়। উন্মুক্ত খামারে বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই বাৎসরিক টিকার কোর্স শুরু করতে হয়।
লেখক: ডাঃ এ, এইচ. এম. সাইদুল হক
এক্সিকিউটিভ, ভেটেরিনারী সার্ভিসেস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল
তথ্যসূত্র: পোলট্রি, পশুসম্পদ ও মৎস্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকা ‘খামার’
গবাদিপশুর থাইলেরিয়াসিস রোগ ও প্রতিকার
থাইলেরিয়াসিস গবাদিপশুর রক্তবাহিত এক প্রকার প্রোটোজোয়াজনিত রোগ। এই জীবাণু গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়াকেআক্রান্ত করে। সাধারণত গ্রীষ্মকালে থাইলেরিয়াসিস রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। থাইলেরিয়ার জীবাণু আক্রান্ত গরুথেকে সুস্থ গরুতে আঠালির মাধ্যমে এ রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকাল আঠালির প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির জন্যউপযুক্ত সময়। এ কারণে গ্রীষ্মকালে গরু আঠালি দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং দ্রুত রোগ ছড়াতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে থাইলেরিয়াসিস দেখা যায়। Theileria গণভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতির প্রোটোজোয়াদ্বারা এ রোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে গরুতে Theileria annulata আক্রান্তের হার খুব কম হলেও মৃত্যু হার প্রায়৯০-১০০%। এ রোগের ক্লিনিক্যাল লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর পশুর রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা খুব নীচে নেমে যায়।ফলে রোগটি নির্ণিত হওয়ার পর চিকিৎসা দিলেও গরুকে সুস্থ করে তোলা প্রায়ই সম্ভব হয় না। তাছাড়া মাঠপর্যায়ে গরুররক্ত পরিবহন বাস্তবে সম্ভব হয়ে উঠে না। এ রোগের চিকিৎসার জন্য উন্নতমানের ঔষধের দাম খুব বেশি এবং তা সর্বত্রসহজে সব সময় পাওয়া যায় না। এ কারণে থাইলেরিয়াসিস অর্থনৈতিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ রোগ সঙ্কর জাতেরগরুতে বেশি দেখা যায়। সঙ্কর জাতের একটি গাভীর দাম ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা। গবাদিপশুর খামারেরক্ষতিকর রোগগুলির মধ্যে থাইলেরিয়াসিস একটি অন্যতম রোগ। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই এ রোগ দেখাযায়। বিভিন্ন কারণে থাইলেরিয়া রোগ নির্ণয় করতে অনেক সময় লেগে যায়। খামারীদের কাছাকাছি এলাকায় প্রায়শরোগ নির্ণয় কেন্দ্র থাকে না। থাইলেরিয়া রোগে প্রতিবছর বাংলাদেশে কোটি কোটি টাকা মূল্যের গো-সম্পদ নষ্ট হয়েথাকে।
রোগের জীবন চক্র
থাইলেরিয়া রোগের মাধ্যমিক পোষক হিসাবে কাজ করে প্রায় ছয় প্রজাতির আঠালি। যথা-
Rhipicephalus Spp
Hyalomma Spp
Boophilus Spp
Haemophysalis Spp
Ornithodoros Spp
Dermacentor Spp
বাংলাদেশে প্রধানত Hyalomma Spp -এর আঠালি Theileria annulata প্রোটোজায়ার মাধ্যমিক পোষক হিসাবেকাজ করে। থাইলেরিয়া আক্রান্ত আঠালির লালা গ্রন্থির মধ্যে অবস্থিত Sporozoits রক্ত শোষণকালে সুস্থ গরুর দেহেপ্রবেশ করে। পরে লসিকা গ্রন্থি ও প্লীহার লসিকা কোষকে আক্রান্ত করে ম্যাক্রোসাইজোন্ট বা ককস্-ব্লু বডি (Koch’s blue bodies) সৃষ্টি করে যা মাইক্রোসাইজোন্ট-এ পরিণত হয়। এই মাইক্রোসাইজোন্ট লোহিত কণিকাকে আক্রান্ত করেপাইরোপ্লাজম সৃষ্টি করে। রক্ত শোষণের সময় এই পাইরোপ্লাজম আঠালির দেহে প্রবেশ করে। আঠালির দেহের মধ্যেবিভিন্ন পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়ে আঠালির লালা গ্রন্থিতে অবস্থান নেয় যা পরে গবাদিপশুর রক্ত শোষণকালে প্রাণীর দেহেপ্রবেশ করে। আক্রান্ত আঠালি সুস্থ গরুকে কামড়ানোর ৭-১০ দিন পর পশুর দেহে তাপ দেখা দেয়।
রোগ লক্ষণ
গরুর প্রবল জ্বর (১০৪-১০৭০ ফা), ক্ষুধামান্দ্য, রক্তশূন্যতা, চোখ দিয়ে পানি ঝরা, রুমেনের গতি হ্রাস, লসিকা গ্রন্থিফুলে যাওয়া, রক্ত ও আম মিশ্রিত ডায়ারিয়া ও নাসিকা থেকে শ্লেম্মা নির্গত হয়। এ সময় গরু শুকিয়ে যায় এবং কোনোএন্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসায় ফল পাওয়া যায় না। দুধ উৎপাদন একদম কমে যায়, গরু শুয়ে থাকতে বেশি পছন্দকরে, হাঁপায় এবং ধীরে ধীরে গরুর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পূর্বে হঠাৎ করে গরুর শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস পায়। সাধারণতআক্রান্ত হবার ১৮-২৪ দিন পর প্রাণী মারা যায়। থাইলেরিয়ায় আক্রান্ত প্রাণী চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলে কিছুটা প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করে তবে প্রাণীটি এ রোগের বাহক হিসাবে কাজ করে।
রোগ নির্ণয়
রোগের লক্ষণ, ইতিহাস এবং চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রাথমিক ভাবে এই রোগ নির্ণয় করা যায়। ল্যাবরেটরিতেআক্রান্ত প্রাণীর রক্ত জেম্সা স্টেইন করে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পাইরোপ্লাজম দেখে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসা
রোগ নির্ণয়ে বেশি দেরী হলে চিকিৎসায় তেমন উপকার হয় না। দ্রুত রোগ নির্ণয় করে মাত্রামত Buparvaquone, Diminazene diaceturate ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হবে। সহায়ক চিকিৎসা হিসাবে ভিটামিন ই১২ ইনজেকশন, Hartmann’s Solution ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হবে। সম্ভব হলে রক্ত সংযোজন করতে হবে যা দূরূহ ব্যাপার। আক্রান্তপ্রাণীর শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ খাওয়াতে হবে। পশুকে ছায়াযুক্ত আরামদায়কপরিবেশে রাখতে হবে। প্রচুর ঠান্ডা পানি পান করতে দিতে হবে।
প্রতিরোধ
ডেইরী খামারীদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে থাইলেরিয়া রোগ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। যে কোন মূল্যে পশুর খামারকেউকুন, আঠালি ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। গোয়াল ঘর ও এর চতুর্দিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্রতি ৪ মাসঅন্তর গাভীকে আঠালি প্রতিরোধক ইনজেকশন প্রয়োগ করে আঠালি মুক্ত রাখতে হবে। গ্রীষ্মকালে সপ্তাহে দুই বার গোয়ালঘরে আঠালিনাশক ঔষধ মাত্রামত সপ্রে করলে গোয়াল ঘর আঠালি মুক্ত থাকে। আক্রান্ত এলাকার সন্দেহজনক সকলগবাদিপশুকে Buparvaquone, Diminazene diaceturate ইত্যাদি প্রতিশেধক হিসাবে মাত্রামত প্রয়োগ করাউচিত।
লেখক: ডাঃ মনোজিৎ কুমার সরকার
ভেটেরিনারি সার্জন,উপজেলা পশুসম্পদ অফিস, রংপুর।
তথ্যসূত্র: পোলট্রি, পশুসম্পদ ও মৎস্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকা ‘খামার’
গবাদিপশুর মিল্ক ফিভার রোগ
অধিক দুধ উৎপাদন এবং একই সাথে একের অধিক বাচ্চা প্রসবকারী গাভীর গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাস, প্রসবকালীনসময় এবং প্রসব পরর্বতী ১-৪ দিনের মধ্যে ক্যালসিয়ামের অভাবে শারীরিক স্বাভাবিক তাপবৃদ্ধি ব্যাতিরেকে পেশিরঅবসাদগ্রস্থতার লক্ষণ প্রকাশ হওয়াকে দুগ্ধ জ্বর বলে।
রোগের কারণ
প্রধানত রক্তে আয়নাইজড ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে দুগ্ধ জ্বর হয়। দুধ দেয় (milking cow) এবং দুধদেয় না কিন্তু গর্ভবতী এরূপ গাভীর (dry pregnant cow) ক্যালসিয়ামের পরিমাণে তারতম্য হয়ে থাকে। শুষ্কপিরিয়ডে (dry period) প্রতিদিন ক্যালসিয়ামের চাহিদা থাকে ৪২ গ্রাম। পক্ষান্তরে দুগ্ধবতী গাভীতে প্রতিদিন এর পরিমাণথাকা চায় ৮২ গ্রাম। শুধু তাই নয় dry pregnant cow G ক্যালসিয়াম শোষণের হার ৩৩% হলেও দুগ্ধ জ্বরপ্রতিরোধের জন্য হদুগ্ধবতী গাভীতে এটি ৫২% থাকতে হবে।
প্রধানত তিন কারণে গাভীর হেদহে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে দুগ্ধজ্বর হতে পারে।
১) গাভীর পাকান্ত্র থেকে শোষিত ও অস্থি থেকে রক্তে আগত ক্যালসিয়ামের পরিমাণ ভ্রূণ ও শালদুধের (colostrum) চাহিদার চেয়ে অধিক হলে এ রোগ দেখা দেয়।
২) গর্ভাবস্থা ও কলস্ট্রাম পিরিয়ডে পাকান্ত্রে সুষ্ঠুভাবে ক্যালসিয়াম শোষিত না হলে এ রোগ দেখা দেয়। গাভীর গর্ভকালীনসময়ে গর্ভস্থ বাচ্চার শারীরিক গঠন ও বৃদ্ধির প্রয়োজনে বিশেষ করে হাড়ের গঠন প্রক্রিয়ায় ক্যালসিয়ামের গুরত্ব অধিক।এ জন্য প্রতিদিন প্রায় ৫ গ্রাম করে ক্যালসিয়াম দরকার হয় এবং গর্ভস্থ বাচ্চা তার মার কাছ থেকে এ পরিমাণক্যালসিয়াম গ্রহণ করে।
নিম্নোক্ত কারণে পাকান্ত্রে ক্যালসিয়াম শোষণে ব্যাঘাত ঘটে থাকে-
ক) খাদ্যে ক্যালসিয়ামের অভাব
খ) ক্ষুদ্রান্তে অদ্রবণীয় ক্যালসিয়াম অক্সালেট লবণ সৃষ্টি
গ) অন্ত্রপ্রহদাহ (Enteritis)
ঘ) ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের অনুপাতের তারতম্য (স্বাভাবিক হার ২.৩:১)
ঙ) ভিটামিন ডি এর অভাব ইত্যাদি।
৩) অস্থির সঞ্চিত ক্যালসিয়াম দ্রুত ও পযার্প্ত হারে নিষ্ক্রান্ত না হওয়ার কারণে রক্তে ক্যালসিয়ামের স্বাভাবিক মাত্রা বজায়থাকে না। ফলে এ রোগ দেখা দেয়।
শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি হতে নিঃসৃত প্যারাথরমোন শরীরের হাড় হতে ক্যালসিয়াম ওফসফরাস নিঃসরণের জন্য উদ্দীপনা জোগায়। এ হরমোন ক্যালসিয়াম শোষণে ভূমিকা পালন করে। গর্ভকালের শেষসময়ে খাদ্যে ম্যাগনেসিয়াসের ঘাটতি হলে এ রোগ দেখা দেয় এবং এ সময়ে গর্ভবতী গাভীর শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনেরপরিমাণ বাড়তে থাকে বিধায় এ হরমোন ক্যালসিয়াম নিঃসরণে বাধা দেয়। এ অবস্থা ছাড়াও অধিকহারে দানাদার খাদ্যগ্রহণ (grain engorgement), রুমেন নড়াচড়ায় আড়ষ্ঠতা (rumen stasis) বিশেষ করে ট্রমাটিকরেটিকুলোপেরিটোনাইটিস, উদরাময় জনিত না খাওয়া (starvation), জোর করে শারীরিক ব্যায়াম করানো (forced exercise) এবং অন্যান্য পরিবেশজনিত কারণ বিশেষ করে অতিরিক্ত ঠান্ডা ও বাতাসের আর্দ্রতার কারণে গাভীরশরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দিতে পারে।
রোগ লক্ষণ
গরুর রক্তের সিরামে স্বাভাবিক ক্যালসিয়াম এর মাত্রা হল ৯-১২ মিগ্রা/মিলি। এর মধ্যে অর্ধেক থাকে প্রোটিনের সাহেথবন্ধনযুক্ত অবস্থায় (Protein bound) যা অকার্যকর। বাকী অর্ধেক থাকে আয়নিক অবস্থায়, যা ক্যালসিয়ামের সক্রিয়অংশ। সিরামের ক্যালসিয়াম লেভেল প্রতি ১০০ মিলিতে ৯ মিগ্রা এর নীচে আসলে সাবক্লিনিক্যাল লক্ষণ প্রকাশ পায়।গাভীর রক্তরসে ক্যালসিয়ামের পরিমাণের উপর র্নিভর করে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
এপিডেমিওলজি
দুগ্ধ জ্বর হওয়ার পিছনে বেশ কিছু ফ্যাক্টর কাজ করে। এগুলো হলঃ
বয়স
গাভীর বয়স বৃদ্ধির সাথে এ রোগের প্রার্দুভাব বৃদ্ধি পায়। অধিক বয়স্ক গাভীতে (৪-৫ বাচ্চা প্রসবের পর) এ রোগ অধিকহয়। কারণ বৃদ্ধ বয়সে একদিকে অস্থি থেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন হ্রাস পায়, অন্যদিকে পাকান্ত্রে ক্যালসিয়াম শোষণহ্রাস পায়।
জাত
জার্সি জাতের গাভী (৩৩%) এ রোগ অধিক আক্রান্ত হয়। এছাড়া ব্রাউন সুইস s(Brown Swiss), আইশায়ার(Ayrshere), হলিস্টিন-ফ্রিজিয়ান (Holstein frizian) জাতের গাভীও এ রোগে আক্রান্ত হয়।
হরমোন
বাচ্চা প্রসবের কিছুদিন পুর্ব থেকেই এবং ইস্ট্রাস পিরিয়ডে ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। পরিণামে আন্ত্রিক গতিশীলতাহ্রাস পায় বলে অন্ত্রে ক্যালসিয়ামের শোষণ কমে গিয়ে হাইপোক্যালসেমিয়া বা দুগ্ধ জ্বর দেখা যায়। এছাড়া ইস্ট্রোজেনহরমোন অস্থি থেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশনেও বাধা দেয়।
অর্থর্নৈতিক গুরুত্ব
স্নায়বিক কার্যক্ষমতা বিঘ্নিত হওয়ার ফলে গাভীর স্বাভাবিক আচরণে অসামঞ্জস্যতা দেখা হেদয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেগাভী দাঁড়াতে পারে না। আক্রান্ত গাভীতে প্রসব জটিলতা, গর্ভফুল আটকে পড়া (কারণ এ সময়ে জরায়ুর মাংসপেশীশিথিল থাকায় জরায়ুর সংকোচন ক্ষমতা কমে যায় এবং গর্ভফুল বিচ্ছিন্ন ও পৃথক হওয়ার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত হয়) ইত্যাদি জটিল সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া জরায়ুর পেশীর শিথিলতা বা দুর্বল হওয়ার কারণে জরায়ু থলথলে(flabby) হয় এবং জরায়ুর র্নিগমনের (uterine prolapse) সম্ভবনা বেড়ে যায়। যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসার অভাবেগাভী মারা যায়। মিল্ক ফিভার এর কারণে গাভীর উর্বরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। আক্রান্ত গাভীতে ওলান প্রদাহের সম্ভবনাবেড়ে যায়। কারণ, এ সময়ে বাঁটের স্ফিংটার পেশী শিথিল থাকার ফলে বাঁটের ছিদ্র (teat canal) দিয়ে ব্যাকটেরিয়াপ্রবেশের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে গাভী মারা যায়।
চিকিৎসা
দুধ জ্বরের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা হল ক্যালসিয়াম বোরোগ্লুকোনেট (৪৫০ থেকে ৫৪০ মিলির ২০% সলিউশন)। এ মাত্রারসলিউশনে ৯ গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে যা সরাসরি শিরায় বা চামড়ার নিচে দিতে হয়। বাজারে এ ধরনের বিভিন্নক্যালসিয়াম সলিউশন এর যে কোনটি প্রস্তুতকারক কোমপানীর নির্দেশমত প্রয়োগ করতে হবে। চিকিৎসার ফলেপ্রতিক্রিয়া দ্রুত হ্রাস পায় এবং ইনজেকশন দেয়ার সাথে সাথেই শতকরা ৬০ ভাগ এবং ২ ঘন্টার মধ্যে ১৫ ভাগ গাভীআরোগ্য লাভ করে। অপযার্প্ত মাত্রায় ক্যালসিয়াম সলিউশন দিয়ে চিকিৎসা করলে গাভী সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয় না এবংপশু উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয় না। অপরদিকে ক্যালসিয়াম সলিউশন অতিরিক্ত মাত্রায় এবং দ্রুত শিরায় ইনজেকশন দিলেপশুর মৃতু্যর আশঙ্কা থাকে । উল্লেখ্য, এ রোগে প্রতি লিটার দুধ হতে ১.২ গ্রাম ক্যালসিয়াম বের হয়ে যায়। হিসাব করেদেখা গেছে ১৮ লিটার দুধ দিতে সক্ষম একটি গাভীর প্রতি দিন ২২ গ্রাম ক্যালসিয়াম ব্যয়িত হয়। কাজেই উপরোক্তপরিমাণ ক্যালসিয়াম শুধুমাত্র কয়েক ঘন্টার ঘাটতি পূরণে সক্ষম নয়। এ কারণে পূর্বের অবস্থার প্রত্যার্বতন প্রতিরোধে(Follow-up therapy) সরাসরি মুখে ক্যালসিয়াম দেয়া যেতে পারে। এ ধরনের ক্যালসিয়াম সলিউশন প্রদান করলেসিরামের স্বাভাবিক ক্যালসিয়াম লেভেল বজায় থাকে এবং পশুর Homeostatic পদ্ধতি কার্যকর হওয়া পর্যন্ত চালিয়েযেতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে শিরায় ক্যালসিয়াম দেয়ার পর দীর্ঘ সময় ধরে সিরামে (serum) ক্যালসিয়াম মাত্রাবজায় রাখার জন্য মুখে আয়নিক ক্যালসিয়াম (Ionic oral calcium) জেল form এ দেয়া হয়। আক্রান্ত গাভী যদি শক্তবা পিচ্ছিল মেঝেতে শায়িত থাকে তবে খড় দিয়ে বিছানার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
প্রতিরোধ
প্রধানত দুটো নীতি অনুসরণ করে গাভীর দুগ্ধ জ্বর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যথাঃ
১) খাদ্য সংশোধন (Correction of diet) এবং
২) প্রি -ডিসপোজিং ফ্যাক্টর সংশোধন (Correction of pre-disposing factors)
খাদ্য সংশোধন
গাভীর শুষ্ক অবস্থায় ক্যালসিয়াম সরবরাহ পরিহার করতে হবে কারণ উচ্চ মাত্রার ক্যালসিয়াম থাকলে হাড়েরক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। ফলে বাচ্চা প্রসব ও কলস্ট্রামের জন্য প্রচুর ক্যালসিয়াম এর প্রয়োজনেঅস্থি থেকে দ্রুত মবিলাইজেশন হতে পারে না। পাকান্ত্রে হঠাৎ গোলযোগ হলে ক্যালসিয়াম শোষণ হয় না। অপরদিকে অস্থিথেকে ক্যালসিয়াম মবিলাইজেশন হয় না। এর ফলে এ রোগের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের গাভীদের কমপক্ষে ৩-৪ মাসের মত ২চা চামচ করে ডাই ক্যালসিয়াম ফসফেট (DCP) পাউডার দৈনিক একবার খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।ভিটামিন ডি পাকান্ত্রের ক্যালসিয়াম শোষণ এবং অস্থি থেকে রক্তে ক্যালসিয়াম প্রবাহিত করতে সাহায্য করে। তাইভিটামিন ডি প্রয়োগের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
প্রি-ডিসপোজিং ফ্যাক্টর সংশোধন
বয়স, জাত ও হরমোন লেভেলকে বিবেচনায় রেখে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া বাচ্চা প্রসবকালীনসময়ে যাতে ধকল না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য বাচ্চা প্রসবের ৪৮ ঘন্টা পূর্ব ও পরে গাভীকে পর্যবেক্ষণ করতেহবে।
লেখক: ডাঃ এ. এইচ. এম. সাইদুল হক
এক্সিকিউটিভ, ভেটেরিনারী সার্ভিসেস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস
তথ্যসূত্র: পোলট্রি, পশুসম্পদ ও মৎস্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকা ‘খামার
গবাদিপশুর ফুট রট রোগ নিয়ন্ত্রণ
ফুট রট গবাদিপশুর পায়ের ক্ষুরের চারপাশে ও ক্ষুরের মধ্যবর্তী স্থানের টিস্যুর প্রদাহজনিত একটি সংক্রামক রোগ। সকলশ্রেণীর সব বয়সের পশুই (গাভী, বলদ, ষাঁড়, বকনা ইত্যাদি) এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগকে ইন্টারডিজিটালনেক্রোব্যাসিলোসিস, ফাউল ইনদি ফুট, ফুট রট বা ইন্টার ডিজিটাল ফ্লেগমন হিসাবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
কারণতত্ব ও এপিডেমিওলজী
ফুট রট সাধারণত Fusobacterium necrophorum দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে তবে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া যেমনBacterorides melaninogenicus ও এ রোগের কারণ হতে পারে। পরীক্ষামূলকভাবে F. necrophorum গবাদিপশুর ইন্টারডিজিটাল চামড়ার মাঝে ইনজেকশন দিলে ইন্টারডিজিটাল নেক্রোব্যাসিলোসিস এর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লিশানপরিদৃষ্ট হয়। এই ব্যাকটেরিয়ার অধিকাংশ আইসোলেট পরীক্ষা করে দেখো গেছে এরা অ এবং অই গ্রুপের অর্ন্তভুক্ত। এরাএকজাতীয় exotoxin উৎপন্ন করে যা ইনজেকশন করলে গবাদি পশু ও ইঁদুর আক্রান্ত হয়। আবার লিশান থেকে প্রাপ্তআর একজাতীয় isolotes যারা ইন্টারডিজিটাল নেক্রোব্যাসিলোসিস হিসাবে শ্রেণীভুক্ত নয় এবং সুস্থ গরুর পা থেকেসংগৃহীত হয় এরা বায়োটাইপ ই হিসাবে (F. necrophorum subspecies funduliforme) চিহ্নিত হয়। এরা তেমনক্ষতিকারক নয়। Bacteroides nodosus এর স্ট্রেইন যা ভেড়ার ফুট রট করে তা গবাদিপশুর ক্ষুর থেকে সংগৃহীতহয়েছে তবে তা অল্প বিস্তর ইন্টারডিজিটাল ডার্মাটাইটিস করে থাকে। কিন্তু এরা আবার মারাত্নক ইন্টারডিজিটালনেক্রোব্যাসিলোসিস রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়ে থাকে এবং এর ফলে ৫-১০% গবাদিপশু খোঁড়া হয়ে যেতে পারে।সকল বয়সের গরু এবং দুই মাস বয়সের বেশি ভেড়া ও ছাগলে এ রোগ দেখা দিতে পারে। বর্ষা ও স্যাঁৎসেঁতেআবহাওয়ায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়ে থাকে। ডেয়রী খামারের গাভীতে এ রোগ হলে অত্যন্ত ক্ষতি হয়। দেশী জাতেরগরু অপেক্ষা বিদেশী জাতের ও সংকর জাতের গাভীতে এ রোগ মারাত্নক হয়ে থাকে। আক্রান্ত গরুর পায়ের ক্ষত হতেনিঃসৃত রস থেকে রোগজীবাণু অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এ রোগ বিচ্ছিন্নভাবে দেখা দেয় তথাপি তা অনুকূল পরিবেশেব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
রোগ বিস্তার
সাধারণত আক্রান্ত গরু থেকে রোগের বিস্তার ঘটে। আক্রান্ত প্রাণীর ক্ষুরের ক্ষত স্থান থেকে নিঃসৃত রস প্রচুর জীবাণুবহন করে যা থেকে সুস্থ প্রাণী আক্রান্ত হয়ে থাকে। গবাদি পশুর পায়ের ক্ষুরের করোনেট বা দুই ক্ষুরের মধ্যবর্তী স্থানেরটিসু্যতে কোনো কিছু দ্বারা আঘাতের ফলে ক্ষত হলে ও সর্বদা কাদা-পানি বা গোবরের মাঝে পা রাখলে ক্ষতস্থান দিয়েরোগজীবাণু সহজেই দেহে প্রবেশ করে এ রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
এছাড়াও শক্ত স্থান, ধারালো পাথরের নুড়ি অথবা চারণক্ষেত্রের শক্ত ধান বা গমের মুড়া থেকে ক্ষুরের নরম টিসু্যআঘাতপ্রাপ্ত হলে সেখান থেকেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। যে কোনো কারণেই হোক না কেন পা যদি সব সময় ভেজা থাকেতাহলে ক্ষুরের মাঝে ক্ষত হবার সম্ভাবনা বেশি দেখা দেয়। অস্বাস্থ্যকর গোয়াল ঘর হলে রোগের সংক্রমণ বেশি হতেপারে।
রোগ লক্ষণ
আক্রান্ত প্রাণীকে আকষ্মিকভাবে খোঁড়াতে দেখা যায়। সাধারণত এক পায়ে ব্যথা হলেও তা প্রায়শ মারাত্নক হয়ে থাকে।দেহের তাপমাত্রা ১০৩-১০৪ ফা লক্ষ্য করা যায়। ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয় ও গাভীর দৈহিক ওজন ও দুধ উৎপাদন হ্রাসপায়। আক্রান্ত ষাঁড় সাময়িকভাবে অনুর্বর (infertile) হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় পায়ের ক্ষতে পুঁজ হয় ও নেক্রসিসহয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। রোগজীবাণুর সংক্রমণের ফলে অস্থিসন্ধি, সাইনোভিয়া ও টেন্ডনের প্রদাহ দেখাদেয়। ফলে আক্রান্ত গরু মাটিতে শুয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত গরুর চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। যথাসময়ে চিকিৎসা নাকরালে ক্ষুর খসে যেতে পারে ও গরু স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। গরু যদি কয়েক সপ্তাহ যাবৎ খোঁড়াতে থাকে তাহলে দুধউৎপাদন দারুণভাবে কমে যায় এবং দৈহিক ওজনও হ্রাস পায়। চিকিৎসার অভাবে রোগ যদি খুব জটিল আকার ধারণকরে তাহলে আক্রান্ত প্রাণীকে বাতিল ঘোষণা করতে হয়।
রোগ নির্ণয়
রোগের ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রোগলক্ষণ দেখে এ রোগ নির্ণয় করা যায়। এছাড়া পায়ের করোনেটের ক্ষত পরীক্ষা করেএ রোগ সনাক্ত করা যেতে পারে।
ল্যাবরেটরিতে এ রোগের জীবাণু সনাক্ত করা যায়। রোগজীবাণু সুনির্দিষ্টভাবে সনাক্ত করার জন্য পায়ের ক্ষত থেকেসোয়াব নিয়ে গ্রাম স্টেইন ও ব্লাড আগারে কালচার করে এ রোগের জীবাণু সনাক্ত করা যায়।
রোগ সনাক্তকরণে পার্থক্য
রোগের লিশানের স্থান, রোগের প্রকৃতি, লিশানের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দুর্গন্ধ, পালে রোগের ধরন, ঋতু ও আবহাওয়া পর্যালোচনাকরে ফুট রটে আক্রান্ত গরুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায।
ইন্টারডিজিটাল ডার্মাটাইটিস/স্টেবল ফুট রট
গবাদিপশুকে আবদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘ দিন প্রতিপালন করলে সাধারণত এ রোগ দেখা দিয়ে থাকে। তবে অস্বাস্থ্যকরপরিবেশে পালন করা হলে প্রায়শ এ রোগ দেখা দেয়। আবার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে পালিত গরুতেও এ রোগ দেখা দিতেপারে। এ রোগের কারণ ঠিক জানা না গেলেও আক্রান্ত পশু থেকে Bacteroides সনাক্ত করা গেছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষুরের bulb এলাকা থেকে দুর্গন্ধযুক্ত আঠালো রস নিঃসরণ হতে থাকে। লিশান বেদনাদায়ক হয় কিন্তুঅন্য কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না। একাধিক ক্ষুর আক্রান্ত হতে পারে। দীর্ঘ দিন ভুগতে থাকলে ক্ষত মারাত্নকহয় ও সেখানে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে। স্টেবল ফুটরটে ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসায় তেমন উপকার হয় নাতবে ক্ষতস্থানে পরিচর্যা করে সেখানে ব্যাকটেরিয়ানাশক ঔষধ ব্যবহার করলে ফল পাওয়া যায়।
ভেরুকোজ ডার্মাটাইটিস
সাধারণত কাদাযুক্ত ভেজা স্থানে গাদাগাদি করে গরু পালিত হলে তাদের এরোগ হয়ে থাকে। ক্ষুরের planter অঞ্চলেপ্রদাহ দেখা দেয়। চার পায়ের ক্ষুরই আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত স্থান অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয় ও গরু খোঁড়াতে থাকে।আক্রান্ত স্থান থেকে smear নিয়ে পরীক্ষা করলে পর্যাপ্ত সংখ্যক F. necrophorum ব্যাকটেরিয়া সনাক্ত করা যায়। এরোগের চিকিৎসা হচ্ছে, আক্রান্ত স্থান জীবাণুনাশক সাবান ও পানি দ্বারা ভালোভাবে ধুয়ে তারপর সেখানে ৫% কপারসালফেট সলিউশন প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে প্রতিদিন চিকিৎসা করতে হবে। যখন অনেক গরু একই সাথে আক্রান্ত হয়তখন কপার সালফেটের সলিউশনের মাঝে প্রতিদিন ফুট ডিপ প্রয়োগ করতে হবে।
আঘাতজনিত ক্ষত
পায়ের ক্ষুরে কোনো ধারালো বস্তু দ্বারা ক্ষত হলে কিংবা ক্ষুর বেড়ে গেলে তা ভালোভাবে পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে।ল্যামিনাইটিস (Laminitis) হলে গরু প্রায়শ খোঁড়া হয়ে যায় কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কোনো লিশান পরিলক্ষিত হয় না।
চিকিৎসা
আক্রান্ত পশুদেরকে শুকনো পরিষ্কার স্থানে রাখতে হবে। এ্যান্টিবায়োটিকস বা সালফোনামাইডস প্রয়োগ করতে হবে এবংক্ষত স্থান জীবাণুনাশক দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে। চিকিৎসার জন্য প্রোকেইন পেনিসিলিন-জি প্রতি কেজি দৈহিক ওজনেরজন্য ২২,০০০ ইউনিট হিসাবে দিনে দুইবার মাংসপেশীতে ইনজেকশন দিতে হবে।
অক্সিটেট্রাসাইক্লিন প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ মিগ্রা হিসাবে দৈনিক শিরা বা মাংশপেশীতে ইনজেকশন দিতেহবে। ভেড়া ও ছাগলের জন্য প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৭৫ মিগ্রা স্ট্রেপটোমাইসিন এবং ৭০০০ ইউনিট প্রোকেইনপেনিসিলিন মাংসপেশীতে দিলে উপকার হয়।
সোডিয়াম সালফাডিমিডিন প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১৫০-২০০ মিলিগ্রাম হিসাবে শিরা বা পেরিটোনিয়ামেরমধ্যে ইনজেকশন দিলেও কাজ হয়।
ক্ষতস্থান ভালোভাবে জীবাণুনাশক সলিউশন দ্বারা পরিষ্কার করে এন্টিসেপ্টিক ও এসট্রিনজেন্ট ঔষধ প্রয়োগ করেব্যান্ডেজ করে দেয়া যেতে পারে। এছাড়াও ৫% কপার সালফেট বা ৫% ফরমালিন দ্বারা ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে ১০%জিংক সালফেট ব্রাশের মাধ্যমে প্রয়োগ করলেও উপকার হয়।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা
গরুর ক্ষুরে যেন ক্ষত না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিতে হবে।
গোয়াল ঘর বা খামারের প্রবেশ পথে ৫% কপার সালফেট সলিউশন ফুট বাথ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। এইসলিউশন দিনে দুইবার নূতন করে প্রস্তুত করে ফুট বাথ হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে। নিয়মিত এই ফুটবাথে গরু পাডুবালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বহুলাংশে রোধ করা যাবে।
কেমোপ্রোফাইল্যাক্সিসঃ রোগের প্রাদুর্ভাবের সময় প্রতিটি গরুকে দৈনিক ৫০০ মিলিগ্রাম হিসাবে ক্লোরটেট্রাসাইক্লিন ২৮দিন এবং পরে প্রত্যহ ৭৫ মিলিগ্রাম হিসাবে সেবন করানো হলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করা যায়।
গবাদিপশুর খাদ্যে দৈনিক ২০০-৪০০ মিলিগ্রাম অর্গানিক আয়োডাইড (ethylene diamine dihydriodide) খাওয়ানো হলে এ রোগের প্রতিরোধ হয়।
ভ্যাকসিন প্রয়োগঃ মিনারেল অয়েল এডজুভ্যান্ট ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
গবাদিপশুকে কাদা বা ভেজা স্থানে রাখা বা যাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে।
গোয়াল ঘর সব সময় পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
ডেয়রী খামারের ক্ষেত্রে ফুট রট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ডেয়রীখামারের গাভী যেহেতু নিবিড়ভাবে পালিত হয় সেহেতু সেখানে রোগের প্রাদুর্ভাব প্রায়শ ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েথাকে। খাঁটি বা সংকর জাতের গাভীতে এ রোগ হলে পায়ের ব্যথায় মাটিতে শুয়ে পড়ে ও খাদ্য কম খায়। ওলান মাটিরসাথে দীর্ঘ সময় লেগে থাকায় ওলানফোলা রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে। আক্রান্ত গাভীর দুধ উৎপাদন বহুলাংশে হ্রাসপায়। কোনো কোনো সময় পায়ের সন্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এবং পরবর্তী পর্যায়ে গাভী চলাফেরায় অক্ষম হয়ে যায়।যদিও এ রোগে মৃত্যু ঘটে না কিন্তু বর্ণিত আনুসাঙ্গিক কারণে খামারের উৎপাদন দারুণভাবে হ্রাস পেয়ে থাকে। এর ফলেখামারী অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
মাংসের জন্য পালিত ষাঁড়ের (beef cattle) খামারে এ রোগের প্রাদুর্ভাব হলেও খামারীর প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হয়।আক্রান্ত ষাঁড় ঠিকমতো খাদ্য গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় শুকিয়ে যায় ও মাংস উৎপাদন হ্রাস পায়।
উপসংহার
উপরে আলোচিত নানাবিধ কারণে ফুট রট রোগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং এ কারণে খামারীদেরকে গবাদিপশুপালনের প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে। গোয়াল ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুকনো রাখা এবং নিয়মিত গবাদিপশুরসঠিক পরিচর্যা করা অত্যন্ত জরুরি। এ সমস্ত বিধি-ব্যবস্থা নিয়মিত প্রতিপালিত হলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
Tuesday, July 4, 2017
Tagged Under: কৃষির তথ্য, কৃষির প্রযুক্তি, গরু, গরুর রোগ ও প্রতিকার, প্রানীসম্পদ
গরুর রোগ ও প্রতিকার
By:
এক ঘরে সব কিছু
On: 11:03 PM
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment